জেলা প্রতিনিধি, সিলেট: ‘দুইজন মেয়ে লাগবে, একজন অনার্স পাস আইইএলটিএস আছে এমন, অন্যজন এইচএসটি পাস আইইএলটিএস ৬ আছে এমন। অনার্স পাস যিনি স্টুডেন্ট ভিসায় যাবেন ছেলে ১০০% খরচ বহন করবে, ইন্টার পাস যিনি তিনি ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় যাবেন, ছেলে ৬০ থেকে ৭০% খরচ বহন করবে, যেহেতু পারমিটের খরচ অনেক বেশি।’
‘সিলেট বিভাগীয় বিবাহ বন্ধন মেরিজ মিডিয়া’ নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ২১ সেপ্টেম্বর মুসা চৌধুরী নামের একজন ওপরের পোস্টটি দিয়েছেন।
‘সিলেট ম্যারেজ মিডিয়া’ নামের বিয়েবিষয়ক আরেক ফেসবুক পেজে ৩০ সেপ্টেম্বর এমন আরেকটি পোস্ট করেন মোহাম্মদ তায়েফ আহমদ নামের একজন।
এতে তিনি লেখেন ‘আমার মামা একজনের জন্য জানুয়ারি সেশনে এপ্লাই করেছেন/অফার লেটার চলে এসেছে।…একজন মেয়ে চাই…, আমার মামা ডিপেনডেন্ট বানিয়ে তাকে সঙ্গে নিবেন। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ হবে, খরচ আলোচনা সাপেক্ষে বহন করা হবে। কোনো বোন থাকলে যোগাযোগ করবেন। পাত্রী অবশ্যই সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের হতে হবে।’
রোববার যোগাযোগ হয় তায়েফের সঙ্গে। তিনি জানান, তার মামা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার এসেছে। এখন ভিসার আবেদন করবেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে পড়তে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা নেই তার।
তায়েফ বলেন, ‘যেহেতু যুক্তরাজ্যে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের নির্ভরশীল হিসেবে স্বামী/ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই তার মামা বিয়ে করে স্ত্রী নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। তবে যুক্তরাজ্য যাওয়ার খরচের বেশির ভাগ বহন করতে হবে কনের পরিবারকে। তাই মামার জন্য পাত্রী চেয়ে ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়েছি।’
যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি দেশে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করায় শিক্ষার্থী ভিসায় সেসব দেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। প্রবাসীবহুল সিলেটের তরুণদের প্রবাসমুখিতার ইতিহাস অনেক পুরোনো। ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করায় এই প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে আরও বড়েছে।
শিক্ষার্থী ভিসায় নির্ভরশীল হিসেবে ‘স্পাউস’ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় এখন বেড়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম-আইইএলটিএস’ করা পাত্রপাত্রীদের কদর। বেড়েছে ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজও’।
সিলেটের বিয়েভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজ আর ভিসা প্রসেসিং সেন্টারগুলোতে ঢুঁ মারলেই তা টের পাওয়া যায়। আইইএলটিএসে ৬ বা তার ওপরে পয়েন্ট পাওয়াদের বিদেশ যাওয়ার খরচও বহন করছে অনেক পাত্রপাত্রীর পরিবার। এ ক্ষেত্রে অনেক বিয়েই হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক, গন্তব্যে পৌঁছার পর দুজনের মধ্যে আর সম্পর্ক থাকবে না- এমন শর্তে। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা স্বামী-স্ত্রী বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশে।
‘সিলেট বিভাগীয় বিবাহ বন্ধন মেরিজ মিডিয়া’ ফেসবুক গ্রুপে ২১ সেপ্টেম্বর তাহমিনা তান্নি পাত্রের খোঁজে লেখেন- ‘আমি একজন পাত্র চাচ্ছি। স্টুডেন্ট ভিসায় ডিপেনডেন্ট হয়ে ইউকে যাওয়ার জন্য পাত্র চাই। সম্পূর্ণ খরচ বহন করতে হবে। আমার কিছুদিনের মধ্যে অফার লেটার আসবে।’
কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে গিয়েছেন সিলেট নগরের শিবগঞ্জ এলাকার এক তরুণ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি যুক্তরাজ্যের স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়ার পর সিলেটেরই এক মেয়েকে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করি। বিয়ের পর ওই মেয়েকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে আসি। বিনিময়ে মেয়ের পরিবার আমাদের এখানে আসার সব খরচ বহন করে।’
তিনি বলেন, ‘কাবিননামাসহ আমাদের বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও আগে থেকেই শর্ত ছিল যুক্তরাজ্যে আসার পর আমরা আলাদা হয়ে যাব। এখন আমরা আলাদা আছি।’
ইউরোপ বা আমেরিকায় যাওয়া এবং সেখানে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য সিলেট অঞ্চলে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের প্রচলন অনেক আগে থেকেই রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসীদের সেবাপ্রদানকারী সংগঠন ওভারসিজ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক শামসুল আলম।
তিনি বলেন, ‘সিলেটের তরুণদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বহুদিনের। অনেকেই ইউরোপ বা আমেরিকায় যান অবৈধভাবে কিংবা সেখানে গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়েন। ওই দেশের নাকরিককে বিয়ে করলে যেহেতু নাগরিকত্ব পাওয়াটা সহজ হয়, তাই অবৈধ হওয়া অনেকেই সেখানকার কাউকে অর্থের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করে ফেলেন। নাকরিকত্ব পাওয়ার পর তারা ডিভোর্স দিয়ে দেন।’
শিক্ষার্থী ভিসা সহজীকরণ করা ও স্পাউস নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় এমন ঘটনা এখন অনেক বেড়েছে জানিয়ে শামসুল ইসলাম বলেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য এমন কাজ অনৈতিক।
সিলেটে বিদেশগমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি ‘শিক্ষা ভিসায়’ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। বিদেশ গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীরা ভিড় করছেন আইইএলটিএস সেন্টারগুলোতে। অনেক শিক্ষার্থী যাওয়ার সময় নির্ভরশীল হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের। গত চার বছরে সিলেট থেকে শিক্ষার্থী ও তাদের নির্ভরশীল হিসেবে প্রায় লাখখানেক লোক যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক ভিসা প্রসেসিং সেন্টারও অর্থের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের জন্য পাত্রপাত্রী খুঁজে পেতে সহায়তা করে। এ ছাড়া আইইএলটিএসে ভালো নম্বর পাওয়া ও বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাওয়া পাত্রের সন্ধানে ছেলেমেয়ের অভিভাবকরাও এসব সেন্টারে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে ইউকে বেসিস নামের একটি ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের পরিচালক সাইফ আলম সেলিম বলেন, ‘ভিসা প্রত্যাশীরা আমাদের কাছে বিয়ের কাবিনসহ যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে আসেন। তবু যাচাই-বাছাই করার জন্য আমরা তাদের কাছে বিয়ের সময়ের ছবি, হানিমুনের ছবিও দেখতে চাই। এসব দেখালে আমাদের আর সন্দেহের কিছু থাকে না। এসব ডকুমেন্টই আমরা অ্যাম্বাসিতে জমা দেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাম্বাসির সন্দেহ দূর করতে ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের’ ক্ষেত্রেও বিয়ের মতো আয়োজন করা হচ্ছে। সিলেটের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সীমিত পরিসরে এসব বিয়ের আয়োজন করা হয়। বর-করে সাজগোজ করে এসে ছবি তোলেন। কাজী এনে বিয়ে পড়ানো হয়। অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করা হয়। অ্যাম্বাসিরে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে পাত্রপাত্রী ছবি তোলার জন্য একসঙ্গে ঘুরতেও যাচ্ছেন।
গত এক সপ্তাহে অন্তত চারটি বিয়ের আয়োজন হয়েছে নগরের জিন্দাবাজার এলাকার ইস্টিকুটুম রেস্টুরেন্টে। এই রেস্টুরেন্টের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রেস্টুরেন্টে বিয়ের হার বেড়েছে। গত এক মাসে বেশ কয়েকটি বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় সবই হয়েছে সংক্ষিপ্ত পরিসরে।’
জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে শিক্ষা ভিসার শর্ত সহজ করে। ওই সময় থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী। এরপর করোনার কারণে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দেয়। তবে ২০২১ সাল থেকে শিক্ষা ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে ও যক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার হিড়িক পড়ে।
আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আইইএলটিএস কোর্সের জন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে জানিয়ে সিলেট ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট অ্যাসোসিয়েশন (সেলটা)-এর সভাপতি খালেদ চৌধুরী জানান, তাদের সংগঠনের অধীনে ৪০টির বেশি আইইএলটিএস সেন্টার রয়েছে। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ভিসা বেশি হচ্ছে। যে কারণে ইংরেজি শিক্ষার জন্য আইইএলটিএস সেন্টারগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিড় বেড়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রতি সপ্তাহে একটি করে পরীক্ষা নিচ্ছে। মাসে ২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আইএলটিএস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার মো. কফিল হোসেইন চৌধুরী বলেন, ‘যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশের ভিসা সাকসেস রেট ভালো হওয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য বহির্গামী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে আইইএলটিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও দু-তিন গুণ বেড়েছে।’
সিলেটে শিক্ষা ভিসা প্রসেসিং নিয়ে কর্মরতদের সংগঠন ‘ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সিলেট শাখার সভাপতি মো. ফেরদৌস আলম জানান, যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখার জন্য শিক্ষা ভিসা অনেক সহজ করায় এখন অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন। যুক্তরাজ্য ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশেও শিক্ষা ভিসায় যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
তবে সব শিক্ষার্থীকেই সঠিক তথ্য দিয়ে বিদেশ যাওয়া উচিত এবং সেখানে গিয়ে যেনো কোর্স সম্পন্ন করেন সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিত বলেও অনুরোধ জানান তিনি।